পিরিয়ড বা মাসিক নারীদের জীবনে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সাধারণত, প্রতি ২৮ দিন পর পর এই প্রক্রিয়াটি পুনরাবৃত্তি হয়। তবে বিভিন্ন কারণে এই স্বাভাবিক চক্রে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। অনিয়মিত পিরিয়ড, দেরিতে পিরিয়ড হওয়া, অথবা পিরিয়ড একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়া – এই সমস্ত কিছুই উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই “পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” এর খোঁজ করেন। কিন্তু এই ঔষধগুলো আসলে কী, কখন এদের প্রয়োজন হয়, এবং এর কোনো বিকল্প আছে কি না – এই সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, “পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” কোনো সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান নয়। এটি মূলত হরমোন-ভিত্তিক চিকিৎসা যা শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শেই নেওয়া উচিত। নিজে থেকে কোনো ঔষধ সেবন করা বিপজ্জনক হতে পারে।
কখন প্রয়োজন হয় পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ?
সাধারণত, নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে ডাক্তার “পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” সাজেস্ট করতে পারেন:
১. অনিয়মিত পিরিয়ড: যদি কোনো নারীর পিরিয়ড নিয়মিত না হয়, অর্থাৎ ২৮ দিনের চক্র বজায় না থাকে, তবে ডাক্তার হরমোন পরীক্ষা করে এর কারণ নির্ণয় করতে পারেন। হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। এক্ষেত্রে, হরমোন-ভিত্তিক ঔষধের মাধ্যমে পিরিয়ড নিয়মিত করার চেষ্টা করা হয়।
২. দীর্ঘদিন পিরিয়ড বন্ধ থাকা (অ্যামেনোরিয়া): যদি কোনো নারীর তিন মাসের বেশি সময় ধরে পিরিয়ড না হয় এবং তিনি গর্ভবতী না হন, তবে এটি অ্যামেনোরিয়া নামে পরিচিত। এর বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন – অতিরিক্ত স্ট্রেস, ওজন পরিবর্তন, থাইরয়েড সমস্যা, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) ইত্যাদি। কারণ নির্ণয় করে ডাক্তার “পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” দিতে পারেন।
৩. নির্দিষ্ট কারণে পিরিয়ড পিছিয়ে দেওয়া: বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে, যেমন – তীর্থযাত্রা, পরীক্ষা, বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য অনেক নারী চান তাদের পিরিয়ড কয়েকদিন পিছিয়ে দিতে। এক্ষেত্রেও ডাক্তার স্বল্প সময়ের জন্য হরমোন-ভিত্তিক ঔষধ দিতে পারেন। তবে এটি নিয়মিত অভ্যাস করা উচিত নয়।
পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ কিভাবে কাজ করে?
“পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ”-এ সাধারণত সিন্থেটিক হরমোন থাকে, যেমন – প্রোজেস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেন। এই হরমোনগুলো নারীর স্বাভাবিক মাসিক চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। ঔষধের মাধ্যমে শরীরে এই হরমোনগুলোর সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়, যা ডিম্বাশয়কে ডিম্বাণু তৈরি করতে এবং জরায়ুকে মাসিকের জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করে। ঔষধ বন্ধ করার পর, শরীরে হরমোনের মাত্রা কমে যায় এবং এর ফলে পিরিয়ড শুরু হয়।
বিভিন্ন ধরনের “পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” বাজারে পাওয়া যায়, যেমন – ট্যাবলেট, ইনজেকশন ইত্যাদি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক ডোজে এবং সঠিক সময় পর্যন্ত এই ঔষধগুলো সেবন করা জরুরি।
আরও পড়ুন: পিরিয়ড না হওয়ার কারণ: জানুন প্রাকৃতিক ও ডাক্তারি উপায়ে সমাধান
ডাক্তার সাজেস্টেড পিরিয়ড হওয়ার ঔষধের তালিকা (বাংলাদেশ)
এখানে বাংলাদেশে ডাক্তার কর্তৃক সাধারণত প্রস্তাবিত কিছু প্রধান হরমোনাল ট্যাবলেট এবং তাদের সম্পর্কে কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো:
প্রধান হরমোনাল ট্যাবলেট সমূহ:

- Normens 5 (রেনাটা লিমিটেড)
- সক্রিয় উপাদান: নরেথিস্টেরন ৫ মিগ্রা
- মূল্য: ৳৫৯.৬৬ (১০ ট্যাবলেট) (পরিবর্তনশীল)
- প্রাথমিক ব্যবহার: অনিয়মিত ঋতুস্রাব, এন্ডোমেট্রিওসিস
- Menoral 5mg (স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস)
- মূল্য: ৳৫.৯২ প্রতি ট্যাবলেট (পরিবর্তনশীল)
- বিশেষ সতর্কতা: উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের জন্য সতর্কতা
- Noteron 5mg (ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস)
- মূল্য: ৳৫.০১ প্রতি ট্যাবলেট (পরিবর্তনশীল)
- অর্থনৈতিক সুবিধা: অন্যান্য ব্র্যান্ডের তুলনায় ১৬% সাশ্রয়ী (তুলনামূলক তথ্য)
ঔষধ নির্বাচনের পূর্বে বিবেচ্য বিষয়:
- চিকিৎসার পূর্বশর্ত:
- অবশ্যই গাইনোকোলজিস্ট দ্বারা পরীক্ষা সাপেক্ষে ব্যবহার করা উচিত।
- সম্পূর্ণ মেডিকেল হিস্ট্রি জানানো আবশ্যক।
- বর্তমানে ব্যবহৃত অন্যান্য ওষুধ সম্পর্কে চিকিৎসককে অবহিত করা।
- সাধারণ ব্যবহার বিধি:
- সাধারণত ১০ দিনের কোর্স হিসেবে নির্ধারিত হয়।
- দিনে ২-৩ বার ডোজ দেওয়া হতে পারে।
- নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করতে হবে।
- সতর্কতা ও সম্ভাব্য জটিলতা:
- সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- মাথাব্যথা
- বমি বমি ভাব
- স্তনে ব্যথা
- গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে:
- অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- ঔষধ সেবন বন্ধ করুন।
- জরুরি চিকিৎসা সেবা নিন।
- সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
আরও পড়ুন
পিরিয়ড বন্ধ হওয়ার লক্ষণ: কারণ, উপসর্গ ও কখন ডাক্তার দেখানো উচিত
পিরিয়ড না হলে কি খাওয়া উচিত? ১০টি পিরিয়ড নিয়মিত করার খাবার
পিরিয়ডের সময় কি মিলন করা যায়?
পিরিয়ড নিয়মিত করার অন্যান্য উপায়
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, “পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” এর কোনো প্রাকৃতিক বিকল্প আছে কি না? যদিও ঔষধের মতো দ্রুত ফল পাওয়া যায় না, তবে কিছু প্রাকৃতিক উপায় এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন অনিয়মিত পিরিয়ডকে নিয়মিত করতে সাহায্য করতে পারে:
১. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়াম সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করে এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত ওজন বা কম ওজন – দুটোই পিরিয়ডের অনিয়মিততার কারণ হতে পারে। তাই একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা জরুরি।
২. স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। যোগা, মেডিটেশন, এবং শখের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমে স্ট্রেস কমানো যায়।
৩. কিছু ভেষজ: কিছু ভেষজ যেমন – আদা, হলুদ, মেথি, এবং তুলসী পিরিয়ড নিয়মিত করতে সাহায্য করতে পারে বলে মনে করা হয়। তবে এগুলো ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৪. ভিটামিন এবং খনিজ: কিছু ভিটামিন এবং খনিজ যেমন – ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, এবং ম্যাগনেসিয়াম হরমোনের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে। তবে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
ভয়েস সার্চে অনেকেই “প্রাকৃতিক উপায়ে পিরিয়ড আনার উপায়” অথবা “যোগা করে কিভাবে পিরিয়ড নিয়মিত করব” এই ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন। এই পদ্ধতিগুলো সহায়ক হতে পারে, তবে কোনো গুরুতর হরমোনজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে এগুলো ঔষধের বিকল্প নয়।
আরও পড়ুন: পিরিয়ডের সময় টক খেলে কি হয়? জানুন উপকারিতা ও ঝুঁকি!
পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ ব্যবহারের পূর্বে সতর্কতা
“পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” ব্যবহারের আগে কিছু বিষয়ে অবশ্যই ध्यान রাখতে হবে:
১. ডাক্তারের পরামর্শ: কখনোই নিজে থেকে এই ঔষধ সেবন করবেন না। শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শ এবং প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষধ গ্রহণ করুন।
২. পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: এই ঔষধগুলোর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যেমন – বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা, স্তনে ব্যথা, ওজন বৃদ্ধি, Mood swings ইত্যাদি। ঔষধ সেবনের পর কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে तुरंत ডাক্তারকে জানান।
৩. চিকিৎসার ইতিহাস: ডাক্তারকে আপনার পূর্বের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং অন্যান্য ঔষধের ব্যাপারে বিস্তারিত জানান। কিছু বিশেষ স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে এই ঔষধ ব্যবহার করা উচিত নয়।
৪. দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার: দীর্ঘ সময় ধরে হরমোন-ভিত্তিক ঔষধ ব্যবহার করার কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে। তাই ডাক্তার নিয়মিত আপনার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন।
শেষ কথা:
পিরিয়ড নারীদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনিয়মিত পিরিয়ড বা দীর্ঘদিন পিরিয়ড বন্ধ থাকা উদ্বেগের কারণ হতে পারে এবং এর সমাধানে “পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে মনে রাখবেন, এই ঔষধ কোনো সাধারণ টোটকা নয়। ডাক্তারের সঠিক পরামর্শ এবং রোগ নির্ণয়ের পরেই এর ব্যবহার করা উচিত। নিজে থেকে ঔষধ সেবন করা বিপজ্জনক হতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন যখন:
- ঔষধ সেবনের পরেও ৭ দিনের বেশি বিলম্ব হলে
- অস্বাভাবিক রক্তস্রাব দেখা দিলে
- তীব্র শারীরিক অসুবিধা অনুভব করলে
FAQS
তাড়াতাড়ি পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ” বলতে মূলত হরমোন-ভিত্তিক ঔষধ বোঝানো হয় যা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা উচিত নয়। ডাক্তার আপনার স্বাস্থ্য এবং হরমোনের মাত্রার উপর ভিত্তি করে সঠিক ঔষধ নির্বাচন করতে পারেন। বাংলাদেশে Normens 5, Menoral 5mg, Noteron 5mg-এর মতো কিছু ঔষধ এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে।
দেরিতে পিরিয়ড হলে আপনার একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ (গাইনোকোলজিস্ট) এর কাছে যাওয়া উচিত। তিনি আপনার সমস্যার কারণ নির্ণয় করবেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করবেন।
পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ খেলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব এবং স্তনে ব্যথা অন্তর্ভুক্ত। গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত এবং ঔষধ সেবন বন্ধ করা উচিত।
পিরিয়ড পিছিয়ে দেওয়ার ঔষধ স্বল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে এবং এটি নিয়মিত অভ্যাস করা উচিত নয়। এই ঔষধ ব্যবহারের পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, বিশেষত যদি আপনার অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে।
মাসিক নিয়মিত করার জন্য ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স সহায়ক হতে পারে। এছাড়াও, ম্যাগনেসিয়ামও হরমোনের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে কোনো ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট শুরু করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
বাংলাদেশে পিরিয়ড হওয়ার ঔষধ যেকোনো ফার্মেসিতে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখালে পাওয়া যায়। তবে মনে রাখবেন, এই ঔষধ কখনোই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কেনা বা সেবন করা উচিত নয়।
আরও পড়ুন:
দাদ চুলকানি দূর করার ক্রিম: 5টি ক্রিম এর নাম ও ব্যবহারের উপায়!
দাদের ঔষধ কি? পুরাতন দাদের চিকিৎসা ও ঘরোয়া সমাধান