অতিরিক্ত ঘাম আমাদের জন্য খুবই বিরক্তিকর। এই সমস্যা সমাধানে, আপনি কি অতিরিক্ত ঘাম কমানোর ঔষধ সম্পর্কে জানতে চান? তবে চিন্তার কোন কারণ নেই, কারণ আজ আমরা আলোচনা করব অতিরিক্ত ঘাম কমানোর ঔষধ, ঘরোয়া উপায় এবং এর পেছনে জড়িত থাকা কারণগুলো।
অতিরিক্ত ঘাম কী এবং কেন হয়?

অধিক ঘাম বা হাইপারহাইড্রোসিস হল এমন একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘাম উৎপন্ন করে। এটি সাধারণত হাত, পা, বগল এবং মুখে বেশি দেখা যায়। এই সমস্যার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো:
- জেনেটিক কারণ: পরিবারে কারও এই সমস্যা থাকলে তা বংশানুক্রমে আসতে পারে।
- মানসিক চাপ: উদ্বেগ, ভয় বা স্ট্রেসের কারণে ঘাম বৃদ্ধি পায়।
- হরমোনাল পরিবর্তন: থাইরয়েড, গর্ভাবস্থা বা মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ঘাম বেশি হতে পারে।
- মেডিকেল কন্ডিশন: ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, সংক্রমণ বা পারকিনসন রোগের কারণেও ঘাম বৃদ্ধি পেতে পারে।
অতিরিক্ত ঘাম কমানোর ঔষধ
অতিরিক্ত ঘাম কমানোর ঔষধ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমে বুঝতে হবে কোন ধরনের ঔষধ আপনার জন্য উপযুক্ত। নিচে কিছু কার্যকরী ঔষধের তালিকা দেওয়া হলো:
১. প্রেসস্ক্রাইব করা অতিরিক্ত ঘাম কমানোর ঔষধ
অ্যান্টিপারস্পিরেন্টস (antiperspirants)
অ্যান্টিপারস্পিরেন্টস হল এমন ঔষধ যা ঘামের গ্রন্থিকে ব্লক করে ঘামের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। এটি সাধারণত বগল, হাত ও পায়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিছু জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে ড্রাইক্লর (Driclor) এবং সেরেভে (SweatStop)। এই ঔষধগুলোতে অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড হেক্সাহাইড্রেট থাকে, যা ঘামের গ্রন্থিকে সংকুচিত করে ঘাম কমায়। সাধারণত রাতে ঘুমানোর আগে শুকনো ত্বকে এটি ব্যবহার করা হয় এবং সকালে ধুয়ে ফেলা হয়। তবে অতিরিক্ত ব্যবহারে ত্বকে জ্বালাপোড়া বা চুলকানির সমস্যা হতে পারে।

অনলাইনে ঘরে বসে Driclor Antiperspirant প্রডাক্টসটি কিনতে চান? তাহলে ক্লিক করুন এই লিংকে।
অ্যান্টিকোলিনার্জিক ড্রাগস
অ্যান্টিকোলিনার্জিক ড্রাগস হল এমন ঔষধ যা স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে ঘামের উৎপাদন কমায়। এই ঔষধগুলো সাধারণত গ্লাইকোপাইরোলেট (Glycopyrrolate) এবং অক্সিবিউটিনিন (Oxybutynin) নামে পরিচিত। এগুলো মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট বা ক্রিম আকারে পাওয়া যায়। তবে এই ঔষধগুলোর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যেমন মুখ শুকানো, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথাব্যথা বা কোষ্ঠকাঠিন্য। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ঔষধ ব্যবহার করা উচিত নয়।
বোটক্স ইনজেকশন
বোটক্স ইনজেকশন বা বোটুলিনাম টক্সিন (Botulinum Toxin) ইনজেকশন ঘামের গ্রন্থিকে অস্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করে ঘাম কমাতে সাহায্য করে। এটি সাধারণত বগল, হাত ও পায়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। বোটক্স ইনজেকশনের প্রভাব সাধারণত ৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই পদ্ধতিটি বেশ নিরাপদ এবং কার্যকরী, তবে এটি কিছুটা ব্যয়বহুল এবং পুনরায় ইনজেকশন নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ইনজেকশনের পর কিছু মানুষের হালকা ব্যথা বা ফোলাভাব অনুভব হতে পারে, যা কয়েক দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
২. প্রাকৃতিক উপায়
পানির খাওয়ার পরিমাণ বাড়ান
শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখা অতিরিক্ত ঘাম কমাতে একটি সহজ কিন্তু কার্যকরী উপায়। যখন শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়, তখন ঘামের মাধ্যমে শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে, যা ঘামের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। বিশেষ করে গরমের দিনে বা শারীরিক পরিশ্রমের পর পানি পান করা জরুরি। এছাড়াও তরমুজ, শসা, কমলার রস ইত্যাদি পানি সমৃদ্ধ খাবার খান, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে।
গ্রিন টি

গ্রিন টি শুধু ওজন কমানো বা হজমশক্তি বাড়ানোর জন্য নয়, এটি ঘাম কমাতেও সাহায্য করে। গ্রিন টিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের টক্সিন দূর করে এবং ঘামের গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে। দিনে ২-৩ কাপ গ্রিন টি পান করুন। গ্রিন টি ঠান্ডা বা গরম যেকোনো ভাবেই পান করা যায়। তবে চিনি বা দুধ ছাড়া গ্রিন টি পান করা বেশি উপকারী। এটি মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে, যা ঘামের সমস্যা কমাতে সহায়ক।
বেকিং সোডা
বেকিং সোডা একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিপারস্পিরেন্ট হিসেবে কাজ করে। এটি ঘামের গন্ধ এবং পরিমাণ উভয়ই কমাতে সাহায্য করে। বেকিং সোডা ত্বকের pH লেভেলকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করে। ব্যবহারের জন্য ১ চা চামচ বেকিং সোডা এর সাথে সামান্য পানি মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্টটি বগল, হাত বা পায়ের তালুতে লাগান এবং ১৫-২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে ২-৩ বার ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তবে অতিরিক্ত ব্যবহারে ত্বকে শুষ্কতা বা জ্বালাপোড়া হতে পারে, তাই সতর্ক থাকুন।
ঘাম কমানোর অন্যান্য উপায়
পাতলা কাপড় পরিধান
পোশাকের ধরন ঘামের পরিমাণ এবং গন্ধ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতি কাপড় বা breathable ফ্যাব্রিক (যেমন লিনেন, ব্যাম্বু) পরিধান করুন, কারণ এগুলো ত্বকে বাতাস চলাচল করতে দেয় এবং ঘাম শুষে নেয়। টাইট বা সিনথেটিক ফ্যাব্রিকের পোশাক (যেমন পলিয়েস্টার) এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো ত্বকে আটকে যায় এবং ঘামের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। হালকা রঙের পোশাক পরুন, কারণ গাঢ় রঙের পোশাক সূর্যের তাপ শোষণ করে শরীর গরম করে তোলে।
ডিওডোরেন্ট ব্যবহার
ডিওডোরেন্ট এবং অ্যান্টিপারস্পিরেন্ট ঘামের গন্ধ ও পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। অ্যান্টিপারস্পিরেন্ট ঘামের গ্রন্থিকে ব্লক করে ঘাম কমায়, অন্যদিকে ডিওডোরেন্ট ঘামের গন্ধ দূর করে। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ডিওডোরেন্ট এবং অ্যান্টিপারস্পিরেন্ট পাওয়া যায়, যেমন ড্রাইক্লর, নিভিয়া, ডাভ ইত্যাদি। রাতে ঘুমানোর আগে ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করলে এটি ভালোভাবে কাজ করে। তবে ত্বকে জ্বালাপোড়া বা অ্যালার্জি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ইয়োগা ও মেডিটেশন
মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ ঘামের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। ইয়োগা এবং মেডিটেশন মানসিক চাপ কমাতে এবং শরীরকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত ইয়োগা ও মেডিটেশন করলে স্নায়ুতন্ত্র শান্ত হয়, যা ঘামের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ১৫-২০ মিনিট ধ্যান বা ইয়োগা করুন। বিশেষ করে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (প্রাণায়াম) এবং শবাসন ঘাম কমাতে খুবই কার্যকরী।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
খাদ্যাভ্যাস ঘামের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু খাবার ঘামের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন:
- মসলাদার খাবার: মরিচ, গরম মসলা ইত্যাদি শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ঘামের পরিমাণ বাড়ায়।
- ক্যাফেইন: কফি, চা, চকলেট ইত্যাদিতে থাকা ক্যাফেইন স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে ঘাম বাড়ায়।
- অ্যালকোহল: অ্যালকোহল রক্তনালীকে প্রসারিত করে এবং শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ঘামের সমস্যা বাড়ায়।
এই খাবারগুলো এড়িয়ে চলুন এবং এর পরিবর্তে শাকসবজি, ফলমূল, শস্য এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান। এগুলো শরীরকে ঠান্ডা রাখে এবং ঘামের সমস্যা কমায়।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
যদি অতিরিক্ত ঘাম কমানোর ঔষধ বা প্রাকৃতিক উপায়ে সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে দেরি না করে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। তিনি আপনার সমস্যার মূল কারণ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা দেবেন। কিছু ক্ষেত্রে সার্জারিরও প্রয়োজন হতে পারে, যেমন:
- আইয়নটোফোরেসিস: এই পদ্ধতিতে হালকা বৈদ্যুতিক প্রবাহ ব্যবহার করে ঘামের গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
- সার্জারি: ঘামের গ্রন্থি অপসারণ বা স্নায়ু কাটার মাধ্যমে ঘাম কমানো যায়।
FAQs
ঘাম কমাতে গ্রিন টি, শসা, তরমুজ এবং পানি সমৃদ্ধ খাবার খান। এগুলো শরীর ঠান্ডা রাখে এবং ঘাম কমায়।
ভিটামিন ডি এবং বি কমপ্লেক্সের অভাবে ঘাম বেশি হতে পারে। এই ভিটামিনের অভাব পূরণ করতে ডিম, মাছ, দুধ এবং সবুজ শাকসবজি খান।
দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেসের কারণে শরীরের সিম্প্যাথেটিক নার্ভ সিস্টেম সক্রিয় হয়, যা ঘামের গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে।
কপাল ঘামা ভিটামিন ডি এর অভাব, থাইরয়েড সমস্যা বা মানসিক চাপের লক্ষণ হতে পারে।
ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, ইনফেকশন বা লো ব্লাড প্রেশারে শীতল ঘাম হতে পারে।
বাচ্চাদের কপাল ঘামা সাধারণত ভিটামিন ডি এর অভাব, জ্বর বা অতিরিক্ত গরমের কারণে হতে পারে।
অ্যান্টিপারস্পিরেন্টস, বোটক্স ইনজেকশন বা প্রাকৃতিক উপায়ে ঘাম গ্রন্থির কার্যকলাপ কমানো যায়।
ঘরের মধ্যে ঘাম হওয়ার কারণ হতে পারে অতিরিক্ত গরম, আর্দ্রতা বা ভেন্টিলেশনের অভাব।
উপসংহার
অতিরিক্ত ঘাম কমানোর ঔষধ এবং প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে জানা আপনার সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ গ্রহণ করা উচিত নয়। আপনার অভিজ্ঞতা বা প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে শেয়ার করুন। আমরা আপনার সমস্যার সমাধানে সর্বাত্মক সাহায্য করতে প্রস্তুত।
দ্রষ্টব্য: এই ব্লগ পোস্টে উল্লিখিত তথ্যগুলো শুধুমাত্র শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে। কোন ক্রিম বা চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
আরও পড়ুন:
অতিরিক্ত মুখ ঘামার কারণ কি? মুখ ঘামার সমস্যা ও সমাধান!
শরীর অতিরিক্ত ঘামার কারণ কি? অতিরিক্ত ঘামের কারণ ও প্রতিকার
অতিরিক্ত ঘাম দূর করার ঘরোয়া উপায়: ১০টি প্রাকৃতিক সমাধানের গাইড!
গা ঘামার সমস্যা? জেনে নিন কোন ভিটামিনের অভাবে গা ঘামে!
অতিরিক্ত ঘাম কোন রোগের লক্ষণ? কারণ ও প্রতিকার