একটি সন্তানের জন্মদান একজন নারীর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। যদি সেই প্রসব সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে হয়, তবে মায়ের শরীরে কিছু পরিবর্তন আসে যা স্বাভাবিক প্রসবের থেকে ভিন্ন হতে পারে। অনেক মায়ের মনেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জাগে, আর তা হলো – সিজারের কতদিন পর মাসিক হয়? এই প্রশ্নের উত্তর একেকজনের জন্য একেক রকম হতে পারে এবং এর পেছনে কিছু শারীরিক প্রক্রিয়া কাজ করে। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা সিজারের কতদিন পর মাসিক হয় এবং এই সম্পর্কিত অন্যান্য জরুরি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সন্তান প্রসবের পর মায়ের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। এই হরমোনাল পরিবর্তন মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করে। স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে যেমন একটি নির্দিষ্ট সময় পর মাসিক শুরু হয়, তেমনি সিজারের কতদিন পর মাসিক হয় তাও এই হরমোনাল ভারসাম্যের উপর নির্ভরশীল। তবে, সিজারিয়ান ডেলিভারির কারণে মাসিকের শুরুতে কিছুটা বিলম্ব ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন: সিজারের কতদিন পর সহবাস করা যায়?
সিজারের কতদিন পর সাধারণত মাসিক শুরু হয়?
সাধারণত, সিজারের পর মাসিক ফিরে আসতে ৬ সপ্তাহ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি এক বছর বা তারও বেশি সময় নিতে পারে। এই ভিন্নতার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে।
যে কারণগুলো মাসিকের ফিরে আসাকে প্রভাবিত করে:
১. স্তন্যপান (ব্রেস্টফিডিং): স্তন্যপান করানো মায়েদের মাসিক ফিরে আসতে সাধারণত বেশি দেরি হয়। এর কারণ হলো, স্তন্যপান করানোর সময় শরীরে এক ধরনের হরমোন তৈরি করে, যা ডিম্বস্ফোটন (Ovulation) দমন করে। ডিম্বস্ফোটন না হলে মাসিক হয় না। যে মায়েরা পুরোপুরি স্তন্যপান করান, তাদের মাসিক ফিরে আসতে ৬ মাস বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। অন্যদিকে, যারা ফর্মুলা দুধ খাওয়ান বা আংশিকভাবে স্তন্যপান করান, তাদের মাসিক দ্রুত ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে।
২. হরমোনের মাত্রা: গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের পর নারীর হরমোনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। প্রসবের পর হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগে। এই হরমোনের ভারসাম্য মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করে।
৩. শরীরের পুনরুদ্ধার: সিজার একটি বড় ধরনের অস্ত্রোপচার। এই অস্ত্রোপচারের পর শরীরকে সুস্থ হতে এবং সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার হতে সময় লাগে। শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলো স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মাসিক চক্র শুরু হতে দেরি হতে পারে।
৪. ঘুমের অভাব ও মানসিক চাপ: নবজাতকের যত্ন নিতে গিয়ে নতুন মায়েদের প্রায়শই পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব হয় এবং মানসিক চাপ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত চাপ এবং ক্লান্তি হরমোনের ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে, যা মাসিকের ফিরে আসাকে বিলম্বিত করে।
৫. স্বাস্থ্যগত অবস্থা: মায়ের সামগ্রিক স্বাস্থ্য, পূর্বে বিদ্যমান কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা (যেমন থাইরয়েড সমস্যা) এবং সিজারের পর কোনো জটিলতা দেখা দিলে মাসিক ফিরে আসতে দেরি হতে পারে।
আরও পড়ুন:
সিজারের পর সহবাস করার নিয়ম: কখন এবং কিভাবে শুরু করবেন
সিজারের পর ব্যথা কতদিন থাকে: জানুন দূত ব্যথা কামানো উপায়!
প্রথম মাসিক কেমন হতে পারে?
সিজারের পর প্রথম মাসিক স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। এটি নিম্নলিখিত রূপে দেখা যেতে পারে:
হালকা রক্তপাত: আবার অনেকের ক্ষেত্রে এটি হালকা স্পটিং বা কম রক্তপাত আকারেও হতে পারে।
অনিয়মিত: প্রথম কয়েক মাস মাসিক অনিয়মিত হতে পারে।
ভারী রক্তপাত: প্রথম মাসিক তুলনামূলকভাবে ভারী হতে পারে।
সিজারের পর মাসিক নিয়মিত করার উপায়

সিজারের পর মাসিক অনিয়মিত হওয়া বেশ স্বাভাবিক। শরীরের হরমোনগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে এবং প্রসবের ধকল সামলাতে কিছুটা সময় লাগে। বিশেষ করে যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাদের ক্ষেত্রে মাসিক দেরিতে বা অনিয়মিত হতে পারে। তবে কিছু উপায় অবলম্বন করে আপনি মাসিকের নিয়মিতকরণে সাহায্য করতে পারেন।
১. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
- পুষ্টিকর খাবার: সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। আপনার খাদ্যতালিকায় প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার, প্রোটিন (ডিম, মাছ, মাংস) এবং ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার (দুধ, দই) রাখুন। ভিটামিন সি এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রসব-পরবর্তী সময়ে আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট চালিয়ে যাওয়া উচিত।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম: নবজাতকের যত্ন নিতে গিয়ে নতুন মায়েদের ঘুমের অভাব হওয়া স্বাভাবিক। তবে পর্যাপ্ত বিশ্রাম হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে crucial। যখনই সুযোগ পান বিশ্রাম নিন, এমনকি ছোট ছোট ঘুমও উপকারী।
- পর্যাপ্ত পানি পান: শরীরকে সতেজ রাখতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি।
২. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ:
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: সন্তানের যত্ন এবং নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার চাপ অনিয়মিত মাসিকের একটি বড় কারণ হতে পারে। ধ্যান, হালকা ব্যায়াম, প্রিয়জনের সাথে কথা বলা, বা শখের পেছনে সময় দিয়ে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন।
- সহায়তা নিন: পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সাহায্য নিন। তাদের সাথে আপনার অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিন। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না।
৩. নিয়মিত হালকা ব্যায়াম:
- হাঁটাচলা: সিজারের পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা হাঁটাচলা শুরু করুন। নিয়মিত হালকা শারীরিক কার্যকলাপ রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং হরমোনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত strenuous ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন এবং আপনার শরীরের কথা শুনুন।
৪. বুকের দুধ খাওয়ানো এবং তার প্রভাব বোঝা:
- যদি আপনি শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ান, তাহলে ইমব্যালেন্স হরমোনের কারণে মাসিক ফিরে আসতে বা নিয়মিত হতে দেরি হতে পারে। এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করলে বা কমিয়ে দিলে মাসিক সাধারণত দ্রুত নিয়মিত হয়। তবে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়ও গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে, তাই জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
৫. ওজন ব্যবস্থাপনা:
- শারীরিক ওজন হরমোনের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে। হঠাৎ করে অতিরিক্ত ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি দুটোই মাসিকের অনিয়মিত হওয়ার কারণ হতে পারে। স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত?
যদিও সিজারের কতদিন পর মাসিক হয় তা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে, নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:
- প্রসবের তিন মাস পরেও যদি মাসিক শুরু না হয় (এবং আপনি বুকের দুধ না খাওয়ান)।
- যদি প্রথম মাসিকের পর অতিরিক্ত রক্তপাত হয়।
- যদি মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা অনুভব করেন।
- যদি মাসিকের চক্র অস্বাভাবিক মনে হয়।
এই লক্ষণগুলো উপেক্ষা করা উচিত নয়। ডাক্তারের পরামর্শ সঠিক রোগ নির্ণয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায়, সিজারের কতদিন পর মাসিক হয় তা বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভরশীল। বুকের দুধ খাওয়ানো না হলে সাধারণত ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে মাসিক শুরু হতে পারে। তবে, ব্যক্তিভেদে এর ব্যতিক্রম হওয়া স্বাভাবিক। নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখুন এবং কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। মাতৃত্বের এই সময়ে নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
দ্রষ্টব্য: এই ব্লগ পোস্টটি শুধুমাত্র সাধারণ তথ্যের জন্য। আপনার শারীরিক অবস্থার জন্য সর্বদা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
FAQS
বুকের দুধ না খাওয়ালে সাধারণত ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে।
হ্যাঁ, বুকের দুধ খাওয়ালে প্রোলাক্টিনের কারণে মাসিক দেরিতে হতে পারে।
উত্তর: হ্যাঁ, প্রথম কয়েক মাস মাসিক অনিয়মিত হতে পারে।
বুকের দুধ না খাওয়ালে প্রসবের তিন মাস পরেও মাসিক শুরু না হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
প্রথম মাসিকে একটু বেশি রক্তপাত হতে পারে, তবে অতিরিক্ত হলে ডাক্তার দেখান।
হ্যাঁ, কারো কারো ক্ষেত্রে পেটে হালকা ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে।
সাধারণত তেমনটা হয় না, তবে ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
হ্যাঁ, ডিম্বস্ফোটন আগে হতে পারে এবং গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
হরমোনের ভারসাম্য ফিরে আসতে কয়েক মাস লাগতে পারে, তাই মাসিক স্বাভাবিক হতেও কিছুটা সময় লাগতে পারে।
আরও পড়ুন:
পিরিয়ডের ব্যথা হলে কি বাচ্চা হয় না? আসল সত্যতা জানুন!
ref: First Period After C-section: When & What To Expect (2025)